
সুগম হল ডিজিটাল ব্যাংকের পথ
প্রথাগত ব্যাঙ্ক এবং ডিজিটাল ব্যাঙ্কগুলির মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হল বর্ধিত গ্রাহক অভিজ্ঞতা। ভার্চুয়াল ব্যাঙ্ক হিসাবে ডিজিটাল ব্যাঙ্কগুলিকে প্রায়শই অনলাইন বা মোবাইল ব্যাঙ্কিং প্ল্যাটফর্ম মনে করা হলেও ধারনাটি ভুল। এক মনে করার কারণ উভয়ের মধ্যেই অ্যাকাউন্ট পরিচালনা, তহবিল স্থানান্তর এবং ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইটে বা মোবাইলের মাধ্যমে বিল পরিশোধের মতো মৌলিক ব্যাঙ্কিং লেনদেন জড়িত।
কিন্তু ডিজিটাল ব্যাঙ্কগুলি আরও পরিশীলিত এবং বিস্তৃত। গ্রাহকের অভিজ্ঞতাকে আরও নিরবিচ্ছিন্ন, কার্যকরী এবং দক্ষ করে তোলার লক্ষ্যে ব্যাংকিং পণ্য ও পরিষেবাদি সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রতিটি ব্যাঙ্কিং কার্যকলাপ, প্রক্রিয়া এবং পর্যায়ে তারা প্রযুক্তির ব্যবহার জড়িত। এই ব্যবস্থায় শারীরিক অবস্থানে থাকার প্রয়োজনীয়তা দূর করুন।
ডিজিটাল ব্যাঙ্কগুলি ক্রেডিট এবং ঋণের সাধারণ ব্যাঙ্কিং লেনদেনের বাইরে গ্রাহকের অভিজ্ঞতাকে উন্নত করার জন্য বিগ ডেটা, মেশিন লার্নিং এবং উচ্চ মাত্রার অটোমেশন, লিভারেজিং ক্লাউড, অ্যানালিটিক্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-এর মতো প্রযুক্তি এবং নেতৃস্থানীয় অনুশীলনের উপর খুব বেশি নির্ভর করে। তারা প্রযুক্তির উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল এবং বাস্তুতন্ত্রের সাথে কাজ করে।
কিন্তু ডিজিটাল ব্যাঙ্ক এবং ঐতিহ্যবাহী ব্যাঙ্কগুলির মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য হল গ্রাহকদের যাত্রা। একটি ডিজিটাল ব্যাঙ্কের যাত্রা শুরু হয় অনলাইনে এবং কঠোরভাবে অনলাইনে থাকে (অথবা একটি স্মার্টফোন অ্যাপের মাধ্যমে), কোনও শারীরিক অবস্থানে যাওয়ার প্রয়োজনকে পরিত্যাগ করে৷ “তারা এন্ড-টু-এন্ড পরিবেশন করে ঐতিহ্যবাহী ব্যাঙ্কের সাথে প্রতিযোগিতা করার চেষ্টা করে না। তাদের ক্রিয়াকলাপকে সমর্থন করার জন্য তাদের কোন শাখা নেই এবং তাদের বিভাগে পৌঁছানোর জন্য সাধারণত মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে। বিশ্বমানের গ্রাহক এবং ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতা যা তাদের আলাদা করে।
এবং যদিও ঐতিহ্যবাহী ব্যাঙ্কগুলিতে প্রচুর সংখ্যক কর্মী থাকে এবং প্রায়শই শাখাগুলির একটি নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করে, ডিজিটাল ব্যাঙ্কগুলি হল এই ধারণার বিরোধী – সরাসরি প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে কাজ করা – একটি স্বয়ংক্রিয় ইলেকট্রনিক পেমেন্ট প্রক্রিয়া যা সূচনা থেকে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি পর্যন্ত আর্থিক লেনদেনের গতি বাড়াতে ব্যবহৃত হয়। এবং মানুষের এবং ম্যানুয়াল হস্তক্ষেপ মুক্ত। এটি করার মাধ্যমে তারা তাদের খরচ-থেকে-আয় অনুপাতকে ঐতিহ্যবাহী ব্যাঙ্কের তুলনায় বেশ কম রাখতে পারে এবং এই সঞ্চয়গুলি তাদের গ্রাহকদের কাছে উচ্চ সুদের হার বা কম ঋণের হারের মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়।
প্রশ্ন বা উদ্বেগের সাথে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে ডিজিটাল ব্যাঙ্কগুলি ঐতিহ্যগত ব্যাঙ্কগুলির তুলনায় অ্যাপের মাধ্যমে বা রোবো পরিষেবার মাধ্যমে গ্রাহকদের পরিষেবা দিতে সক্ষম হয় যেগুলি সাধারণত গ্রাহকদের কল সেন্টারের সাথে যোগাযোগ করতে বা তাদের শাখায় যেতে হবে।
পরিশেষে, একটি প্রতিভা বা কর্মশক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে ডিজিটাল ব্যাঙ্কগুলি টেক-স্যাভি ব্যক্তি, বা বিভিন্ন, বহু-বিভাগীয় ব্যাকগ্রাউন্ডের লোকদের নিয়ে গঠিত যারা মূল্য প্রস্তাবকে চালিত করার জন্য একটি দল হিসাবে কাজ করে।
ঠিক এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে দেশে ডিজিটাল ব্যাংক স্থাপনে বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে নীতিমালা অনুমোদন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ব্যাংক গড়তে উদ্যোক্তাদের মূলধন লাগবে ১২৫ কোটি টাকা। নীতিমালায় বলা হয়েছে, ব্যাংকের উদ্যোক্তা হতে ন্যূনতম ৫০ লাখ টাকার শেয়ার ধারণ করতে হবে। আর ঋণ খেলাপি ও তাদের পরিবারের সদস্যদের এ ব্যাংকের উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।
ডিজিটাল ব্যাংকের এ নীতিমালায় বলা হয়েছে, উদ্যোক্তাদের শেয়ার পাঁচ বছরের আগে হস্তান্তর করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হবে। আর বাংলাদেশ ব্যাংক তিন বছরের আগে এ অনুমোদন দিতে পারবে না।
ব্যাংকটির পরিচালনা সংক্রান্ত কার্যক্রম সম্পর্কে নীতিমালায় বলা হয়, ব্যাংক-কোম্পানি আইন, ১৯৯১ এর ধারা ৩১ এর আওতায় প্রতিটি ডিজিটাল ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে এবং পরিশোধ সেবা (পেমেন্ট সার্ভিস) পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ পেমেন্ট অ্যান্ড সেটেলমেন্ট সিস্টেম রেগুলেশন, ২০১৪ এর বিধান অনুসরণ করতে হবে। এ ব্যাংকের পর্ষদে একই পরিবার থেকে ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী তিনজনের অধিক পরিচালক থাকতে পারবেন না।
এছাড়া পর্ষদে কমপক্ষে শতকরা ৫০ ভাগ সদস্য প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং, উদীয়মান প্রযুক্তি, সাইবার আইন ও রেগুলেশন বিষয়ে পর্যাপ্ত শিক্ষা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হতে হবে এবং অবশিষ্ট সদস্যরা ব্যাংকিং, ই-কমার্স এবং ব্যাংকিং আইন ও রেগুলেশন ইত্যাদি বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হতে হবে।
এ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় ছাড়া দৃশ্যমান কোনো কার্যালয় থাকবে না বলে নীতিমালায় বলা হয়েছে। যে কারণে প্রচলিত ব্যাংকের মতো ডিজিটাল ব্যাংকের কোনো শাখা, উপশাখা, এজেন্ট বা উইন্ডো থাকবে না। নিজস্ব এটিএম/সিডিএম/সিআরএম থাকতে পারবে না বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
অপরদিকে বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পে মেয়াদি ঋণ, বৈদেশিক বাণিজ্যে ঋণ বা অর্থায়নেও বিধিনিষেধ আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
নীতিমালায় ডিজিটাল ব্যাংকের ব্যবসা শুরুর পাঁচ বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে তালিকাভুক্তির শর্ত দেওয়া হয়েছে। তবে আইপিওর মাধ্যমে তোলা অর্থের পরিমাণ উদ্যোক্তাদের সরবরাহ করা প্রাথমিক মূলধনের কম হতে পারবে না।
এতে বলা হয়েছে, ডিজিটাল ব্যাংকগুলো প্রচলিত ব্যাংকের মতো জামানত রেখে ঋণ প্রদান করতে পারবে। ঋণ দিতে অস্থাবর সম্পত্তি জামানত রেজিস্ট্রিতে অন্তর্ভুক্ত সম্পত্তি গ্রাহকের সহায়ক জামানত হিসেবে গ্রহণ করতে পারবে। ঋণ বিতরণে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সময়ে সময়ে দেওয়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক বিকল্প ঋণ স্কোরিং গাইডলাইন অনুসরণ করবে।
আর্থিক অন্তর্ভুক্তি কার্যক্রমকে আরও সমৃদ্ধ করতে অনলাইন প্রযুক্তি নির্ভর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেশিন লার্নিং, ব্লকচেইন এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের অন্যান্য অগ্রসরমান প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে ডিজিটাল ব্যাংকগুলোকে।
নীতিমালায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল ব্যাংক লেনদেনের জন্য কোনো প্রকার স্পর্শযোগ্য ‘ইনস্ট্রুমেন্ট’ ইস্যু করতে পারবে না। এ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার (সিইও) প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং, ব্যাংকিং রেগুলেশন ও নির্দেশনা ইত্যাদি বিষয়ে কমপক্ষে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতাসহ ব্যাংকিং পেশায় কমপক্ষে ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে বলে নীতিমালায় বলা হয়েছে।