
ইলিশ মাছ ৩৩ প্রজাতির
দারুণ এক রহস্যময় অভিপ্রায়ণশীল এই ইলিশ ক্লুপিডি পরিবারের অন্তর্ভুক্ত মাছ। রহস্যময় এই কারণে বলছি যে ইলিশ নাকি লিঙ্গ পরিবর্তন করে। একটা নির্দিষ্ট বয়সে এসে সব পুরুষ ইলিশ স্ত্রীতে রূপান্তরিত হয়।
মৎস্যবিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়ার্ল্ড ফিশ বিভিন্ন তথ্য–উপাত্ত ঘেঁটেঘুঁটে জানাচ্ছে, সারা দুনিয়ায় অ্যালোসিনি উপপরিবারের আওতায় চারটি গণ বা জেনাস রয়েছে এবং ৩৩টি প্রজাতির সদস্য রয়েছে। যারা দেখতে ইলিশের মতো। এর মধ্যে অ্যালোসা গণের ২৫টি প্রজাতি, হিলসা গণের একটি প্রজাতি, গুডুসিয়া গণের ২টি প্রজাতি এবং টেনুয়ালোসা গণের ৫টি প্রজাতির ইলিশজাতীয় মাছ পাওয়া যায়।
এ ছাড়া আমাদের এই উপমহাদেশে সামুদ্রিক জলাশয়ে রিস্টিগ্যাটেরিডি পরিবারভুক্ত ৪টি মাছ রয়েছে, যারা দেখতে ও স্বাদে অনেকটা ইলিশের মতো। এরা হলো চৌক্কা (Ilisha filigera), চৌক্কা ফাইসা (I. megaloptera), I. melastoma এবং Ges Pellona ditchela।

ইলিশ
আমাদের সামুদ্রিক টেরিটরিতে সার্ডিন নামে আরও একধরনের মাছ পাওয়া যায়, যা দেখতে অনেকটা ইলিশের মতো। কিন্তু এটিও ইলিশ নয়। স্যামন ও হেরিং মাছকে অনেকেই ইলিশের কাছাকাছি জাতের মাছ বলে উল্লেখ করে থাকেন। কিন্তু এরা অ্যালোসিনি উপপরিবারভুক্ত নয়। হেরিং মাছের পরিণত বয়সে আকার ইলিশের চেয়ে অনেক ছোট হয়ে থাকে।
ফিশবেস অনুযায়ী বৈশ্বিকভাবে এই মাছ হিলসা শ্যাড বা ইন্ডিয়ান শ্যাড বা রিভার শ্যাড হিসেবে বহুল পরিচিত। তবে অনেকে একে অ্যালোস হিলসা বলেও ডেকে থাকে। ইলিশ অ্যাক্টিনোপ্টেরিজি শ্রেণির ক্লুপিফর্মিস বর্গের ক্লুপিডি পরিবারের অ্যালোসিনি উপপরিবারের টেনুয়ালোসা গণের মাছ। এর বৈজ্ঞানিক নাম টেনুয়ালোসা ইলিশা (Tenualosa ilisha)। আগে এই মাছকে আমরা Hilsa ilisha বলে জানতাম। এই কারণেই ইংরেজিতে এই মাছকে হিলসা নামে ডাকা হয়। ওই টেনুয়ালোসা গণটি দীর্ঘদিন যাবৎ Hilsa গণ নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে হিলসা গণের একটি মাছ পাওয়া যায়, সেটিকে গুর্তা (Hilsa kelee) ইলিশ বলা হয়। এটি আমাদের বঙ্গোপসাগর উপকূলেই বাস করে।

ইলিশ
ইলিশ মাছটির বৈজ্ঞানিক নামকরণ নিয়ে অনেক মত প্রচলিত রয়েছে। প্রথম ১৮০৩ সালে রাসেল নামের এক বিজ্ঞানী বিশাখাপত্তনমের পূর্বাঞ্চলীয় জল থেকে এই মাছ ‘পালাশা’ নামে বৈজ্ঞানিক বৈশিষ্ট্য প্রদান করেন। হ্যামিল্টন বুকানন ১৮২২ সালে এই মাছের নাম দেন Clupanodon ilisha। তারপর বিভিন্ন বিজ্ঞানী এই মাছকে যথাক্রমে Clupea palasah, Alausa palasah, Alausa ilisha, Clupea ilisha, Macrura ilisha নামে চিহ্নিত করেন।
প্রথম মি. রিগান ১৯১৭ সালে এই মাছকে বহুল পরিচিত Hilsa ilisha নামে নামকরণ করেন। পরবর্তী সময়ে ফলার ১৯৩৪ সালে, শ ও শেবেরি ১৯৩৭ সালে এবং মিজরা ১৯৫৩ সালে ইলিশকে হিলসা ইলিশা নামে বিভিন্ন জার্নাল প্রকাশ করেন। মুনরো ১৯৫৫ সালে প্রথম মাছটিকে টেনুয়ালোসা ইলিশা নামকরণ করেন। পরবর্তী সময়ে ফিশার ও বিয়ানচি ১৯৮৪ সালে টেনুয়ালোসা ইলিশা নামটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাসহ উল্লেখ করেন, অর্থাৎ টেনুয়ালোসা গণটিকে প্রতিষ্ঠিত করেন। প্রতিটি প্রাণীর বৈজ্ঞানিক নামের প্রথম শব্দটি হলো গণ বা genus এবং শেষ শব্দটি হলো প্রজাতি বা species, যা ইটালিক হরফে লেখা হয়।

ইলিশ
টেনুয়ালোসা শব্দটি এসেছে লাতিন শব্দ Tenuis থেকে, যার অর্থ হলো পাতলা। পাতলা, সরু ও ঝকঝকে দারুণ স্মার্ট এই টেনুয়ালোসা গণের (ঘরানার) পাঁচ প্রজাতির ইলিশ মাছ রয়েছে। এর মধ্যে আমরা যে ইলিশ খাই, সেই ইলিশ বা T. ilisha পাওয়া যায় পারস্য উপসাগর থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত। তবে প্রধানত বঙ্গোপসাগর উপকূলের দেশসমূহ, শ্রীলঙ্কার উপকূল, টনকিন উপসাগর, এমনকি ভিয়েতনাম উপকূল পর্যন্ত এ মাছের বিচরণ লক্ষ করা গেছে।
T. toli বা চন্দনা ইলিশ এবং T. reevesii ভারত মহাসাগর থেকে জাভা সাগর, দক্ষিণ চীন সাগর পর্যন্ত পাওয়া যায়।
T. macrura মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, জাভা সাগর, সারাওয়াক, থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে পাওয়া যায়।
T. thibaudeaui বা লাওশিয়ান শ্যাড মেলে মেকং নদীতে লাওস, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায়।
T. ilisha প্রজাতি ব্যাপক এলাকাজুড়ে বংশ বিস্তার করলেও বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারেই ৯০-৯৫ শতাংশ পাওয়া যায়। ভারতের রূপনারান, গঙ্গা, গোদাবরী নদীর ইলিশের ডিম সুস্বাদু বলে রয়েছে সুনাম। দক্ষিণ পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশেও এই মাছ পাওয়া যায়।
টেনুয়ালোসা ইলিশার চিহ্নিতকরণ বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে একটু আলোকপাত করা যেতে পারে। ইলিশ প্রজাতির মধ্যে সবচেয়ে বড় ও স্বাদের এই মাছের পিঠের দিকটা নীলচে সবুজ এবং পেটের দিক রুপালি বর্ণের চকচকে। ওপরের চোয়াল ও নিচের চোয়াল প্রায় সমান এবং কিছুটা ভোঁতা। চোয়াল দুটি একটি অপরটিকে ছাড়িয়ে যায় না। পৃষ্ঠপাখনা দেহের মাঝবরাবর নীলচে সবুজ অংশে দেখতে পাওয়া যায়। পৃষ্ঠপাখনা বক্ষপাখনার সামান্য সামনে থাকে। পৃষ্ঠপাখনায় ১৮-২১টি, বক্ষপাখনায় ১৫টি, পেলভিক পাখনায় ৮টি এবং পুচ্ছ পাখনায় ১৮-২৩টি নরম কাঁটা থাকে। পেটের দিকে ত্রিকোণাকার যে কাঁটা বা স্কিউটস থাকে, তার সংখ্যা ৩০-৩৩।
ফ্রোইসি ও পোলি ২০১৭ সালে ফিশবেসে ২৫টি ভাষায় ইলিশ মাছের নাম উল্লেখ করেছেন, যা এখানে ইংরেজি থেকে বাংলায় ভাষায় অনূদিত হলো। নামগুলো স্থানীয় উচ্চারণের সঙ্গে হুবহু না–ও মিলতে পারে। বাংলাদেশে এই মাছকে ইলিশ মাছ, ইলিশ, ইলশা, পদ্মা ইলিশ ইত্যাদি নামে ডাকা হয়। তা ছাড়া এপার বাংলায় ছোট ইলিশ জাটকা নামে এবং ওপার বাংলায় খোকা ইলিশ নামে পরিচিত।
মিয়ানমারে বার্মিজ ভাষায় বলা হয় না-থা-লোক, না-থালাংক। অসমিয়া ভাষায় বলা হয় ‘ইলিহি’। তেলেগু ভাষায় বলা হয় পালাসা, পালাসাহ, পালিয়া, পোলাসা। গুজরাটি ভাষায় বলা হয় চাকশি, চাসকি, পাল্লা। হিন্দিতে বলা হয় হিলসা, পালা। কানাড়া ভাষায় বলা হয়মুল্লাসু, পালাসা, পালিয়া, পোলাসা। মালয়ালাম ভাষায় বলা হয় পালিয়াহ, পালুভা, ভালাভা। মারাঠি ভাষায় বলা হয় পালা, পাল্লা, পালভা। ওডিশা ভাষায় বলা হয় ইলিশ, ইলিশা, জোডি। তামিল ভাষায় বলা হয় উল্লাম, ভেনগান্নাই, সেভা। শ্রীলঙ্কায় তামিল ভাষায় ইলিশকে বলা হয় সেভ্ভা, উল্লাম। পাকিস্তানের পাঞ্জাবি ভাষায় ইলিশকে পাল্লা এবং উর্দুতে পালো ও পুল্লা বলা হয়। ভিয়েতনামে ক্যা-কে বলা হয় ইলিশকে।
যুক্তরাষ্ট্রে ও বৈশ্বিক নাম হিলসা বলেই ডাকা হয়। তবে যুক্তরাজ্যে বলা হয় হিলসা হেরিং। পোলান্ডে পলিশ ভাষায় বলা হয় হিলজা ইনডিজস্কা। পর্তুগালে পর্তুগিজ ভাষায় ইলিশকে বলা হয় পালা। চেক ভাষায় ইলিশের নাম প্লাককা ইলিশা, স্লেড পালাসাহ। ডেনমার্কে ইলিশের নাম হিলসা-স্টামস্লিড। স্প্যানিশ ভাষায় ইলিশের নাম সাবালো হিলসা। সুইডিশ ভাষায় বলা হয় হিনডিস্ক স্টাকসিল। এস্তোনিয়ান ভাষায় ইলিশকে বলা হয় ইন্ডিয়া সালিলুসা। রাশিয়ায় রুশ ভাষায় এই ইলিশকেই ডাকা হয় তেনুয়ালোসা নামে। ইরাকে আরবি ভাষায় ইলিশের নাম শোর। ইরানে ফারসি ভাষায় ইলিশকে কয়েকটি নামে ডাকা হয়, যেমন বার্ক, মাহি খোর কুচিকু, সবোর, সবুর, জাবুর, জমুর। ওমানে ইলিশকে ডাকা হয় চাকোরি নামে। চীনের ম্যান্ডারিন ভাষায় ইলিশের নাম ইচাচা। এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় এই মাছকে তেরুবক বলা হয়।
পুঁটি মাছের যে বিদ্রোহের গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটা দিয়েই ইলিশের জ্ঞাতিগোষ্ঠীর ঠিকুজি–কুলজি শেষ করতে চাই। জলের রাজ্যে বাস করে রাজার সঙ্গে বিদ্রোহের এই সংবাদ হয়তো মৎস্যবিজ্ঞানীরাও জেনে গিয়েছিলেন! তাই দেখতে অনেকটা ইলিশরূপী হলেও এদের ইলিশ জাত থেকে বের করে দিয়েছেন। বর্তমানে ইলিশ প্রজাতি শুধু এই বাংলাতেই নয়, সারা পৃথিবীতে স্বাদে, গুণে, আভিজাত্যে এবং সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ হয়ে রাজ্যত্ব করছে।
তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ মৎস্য অধিদপ্তর প্রকাশিত মৎস্য সপ্তাহ সংকলন; বিএফআরআই, ওয়ার্ল্ডফিশ সেন্টার এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্র।